কমালাপুর থেকে ট্রেনে উঠেই রাতুলের দেয়া ঠিকানাটা আবার দেখে নিলাম । প্রথমে ফুলবাড়ি স্টেশন ,তারপর সেখান থেকে টেম্পুতে করে লালপুর বাজারে যেতে হবে ; লালপুর থেকে রিকশা করে বটতলা বাজার থেকে একটু সামনে গেলেই চেয়ারম্যান বাড়ি। এই চেয়ারম্যান বাড়িই হলো আমার সবচে ভাল বন্ধু রাতুলের বাড়ি। ওর বাড়ি যাবার কারন হল ওর মার অসুস্ততা। খালাম্মা অনেকদিন ধরে অসুস্ত। তাই দেখতে যাওয়া ।
ট্রেনের জানালার পাশে বসে বাইরের প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে এসে পরলাম ফুলবাড়ি স্টেশনে । ফুলবাড়িতে নেমেই টেম্পু করে লালপুর বাজারে গেলাম। টেম্পু থেকে নামতে না নামতেই একটা ছোট ছেলে বয়স ১৩ বা ১৪ হবে আমার কাছে এসে বলল "স্যার কই যাবেন আমারে কন,স্যার আমার রিকশায় উঠেন ।" আমি বললাম আমি তো যাব বটতলা বাজারের সামনে চেয়ারম্যান বাড়ি কিন্তু তুমি তো অনেক ছোট আমাকে নিয়ে রিকসা চালাবে কি করে ? ছেলেটা বলল "আমি পারমু স্যার '' এই কথা বলেই ও আমার হাতের ব্যাগটা চট করে রিকশায় রাখল। আমিও কিছু না ভেবে রিকশাই উঠে গেলাম ।
মাটির রাস্তা তাই রিকশায় জোরে প্যাডেল দিলেও রিকশার বেগ খুব বেশি হচ্ছে না। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল ও মনে হয় রিকশা চালাতে পারবে না কিন্তু ছেলেটা ভালই রিকশা চালায়। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করলে, ও বলল "বাপে আমার নাম দিছিল মোতালেব;কিন্তু মা আদর কইরা ডাকতো মন্টূ মিয়া কইয়া। এহন সবাই ডাহে মন্টূ কইয়া। আহারে আমার মা ডা,বাপের সুন্দর নামটার মানে বোঝলো না ।" আমি বললাম মন্টু নামটাও সুন্দর।
কিছুদূর যেতেই একটা উঁচু ঢাল দেখা গেল। উঁচু ঢালের কাছেই আসতে যখন ভাবলাম রিকশা থেকে নামতে হবে তখনই পিছন থেকে হঠাৎ শোনতে পেলাম "হুট! হুট! চল! চল! " পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম একটি ছোট ছেলে গায়ের জোরে রিকশা ঠেলছে । তখনি মন্টূ বলল" স্যার ও আমার ছোট ভাই নাম ঝণ্টূ । আমার চেয়ে ২ বছরের ছোট ।আমি একা একা রিকশা টানতে পারি না। ও রিকশার পিছনে বইসা থাকে, যখনই দরকার হয় তখনই রিকশা ঠেলা দেয় । স্যার বুঝলেন ভাইটা খুব কামের; ১০০ পাসেন্ট মনোযোগ দিয়া কাম করে । তাই রিকশা চালাইতে আমার খুব বেশি একটা কষ্ট হয় না।
মন্টূর কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইলে ও বলল " স্যার বাপে মরছে ৬ মাস হইছে " তখনি পিছন থেকে ঝণ্টূ ছট করে বলল " ভাই তুই মিছা কস কেন ? বাপে মরছে ৭ মাস হইছে; মায়ে কালকে আমারে কইছে "। " ঐ ৬ আর ৭ একই কথা "- মন্টূ বলল । তারপর মন্টূ আবার শুরু করলো " বুঝলেন স্যার বাপজানের কি জানি হইছিল খালি খালি বমি করত আর বমির লগে মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইত ।টেকার লাইগা ডাক্তার দেখাইতে পারি নাই । বাপে খুব কষ্ট কইরা মরছে। আমার মনে হয় রোগটা খুব সাঙ্গাতিক ছিল
আমি মন্টূর পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্টূ বলল " স্যার আমরা দুই ভাই আর আমার দাদি আর আমার মা থাকে। স্যার মার শরীরটা ভালা না,সারাদিন শুয়াইয়া থাকে।মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া পইড়া থাকে,কোন হুশ থাকে না ।" আমি বললাম তোমার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই? মন্টূ বলল এক কাকা ছিল উনিও অনেকদিন আগে মইরা গেছে ।" ঝণ্টূ আবার ঠেলা শুরু করলো। মন্টূ বলল "দেখলেন স্যার আমার ভাই কত কামের। কঅন লাগে না এর আগেই ধাক্কা দেয়া শুরু কইরা দেয়।" অনেকক্ষণ ধাক্কা দিয়ে আবার রিকশার পিছনে বসলো ঝণ্টূ । রিকশার পিছনে বসেই ঝণ্টূ বলল "ও ভাই তুই না কইছিলি আমারে বিরানি কিন্না খাওয়াবি ? কই খাওাইলি না তো । কবে খাওাইবি ?"মন্টূ বলল চুপ থাক এত খাই খাই করস কেন ? বিরানি না খাইলে মরবি না কিন্তু মা ওষুধ না খাইলে মইরা যাইব । তহন ভালা হইবেনে ।" আমি মন্টূকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার মাকে ডাক্তার দেখাউনি? ঝণ্টূ ফট কইরা বলল " দেখাইছি স্যার , রহিম-মারে; হালা..." "ওই তুই চুপ থাক প্রশ্ন তরে করছে না আমারে করছে ? স্যার মারে রাহিম ডাক্তাররে দেখাইছিলাম, উনি বলছে বড় অসুখ শহরে নিয়া যাইতে হইব । ডাক্তারে কিছু দামি ওষুধও খাইতে কইছে। প্রতিদিন ৩০ টাকা কইরা লাগে। এখন টাকা জমাইতাছি যত তাড়াতাড়ি পারি মারে শহরে নিয়া যামু " আমি মন্টূকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার দৈনিক কত টাকা আয় হয়। মন্টূ বলল " স্যার ঠিক নাই কোনদিন ১০০ টাকা , কোনদিন ১২০ বা ১৫০ । ২০০ টাকাও রোজগার হয়। এর মধ্যে আবার ৪০ টাকা মহাজনকে দিতে হয় ।
আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করলাম মন্টূ আঞ্চলিক ভাষা এবং শুদ্ধ ভাষা একত্র করে কথা বলছে ।আমি তাই মন্টূকে মজা করে জিজ্ঞেস করলাম "মন্টূ ,তুমি তো দেখছি শুদ্ধ ভাষাও কথা বলতে পারো ।"মন্টূ একটু লজ্জিত কন্ঠে বলল " স্যার আসলে মানে আমি ক্লাস 4 পর্যন্ত পরছি।বাপ মরণের পর আর পড়া হয় নাই। ওইহান থিকাই কিছু কিছু শুদ্ধ ভাষা শিখছি । তাই শহরের মানুষ দেখলে মাঝে মাঝে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি । "ঝন্টূ তৎক্ষণাৎ মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলল " ভাই তুই তো আমার লগেও শুদ্ধ ভাষায় কথা কস " মন্টূ বলল "এত বেশি বক বক না কইরা নাইমা ঠেলা দে ।" ঝণ্টূ এক লাফ দিয়ে নেমেই ঠেলা শুরু করলো
মানুষের নিষ্ঠুর পরিহাস মানুষকে অনেক কিছুই করতে বাধ্য করে । যে ছেলেদের এখন মা-বাবার আদরে বড় হবার কথা , স্কুলে যাবার কথা , আনন্দ -ফুর্তি করার কথা তারাই নাকি এখন জীবনের নির্মম বাস্তবতার সম্মখিন । তারা এত কম বয়সেয় নেমে পরেছে জীবন সংগ্রামে । জীবনটা তাদের কাছে বড়য় কঠিন ।
সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে । সামনেই প্রখাণ্ড বটগাছের বটতলা বাজার দেখা যাচ্ছে । এর একটু সামনেই চেয়ারমেন বাড়ি । গন্তব্যর শেষ ঠিকানা । রিকশাও চলছে তার গতিতেই । বটতলা বাজারে এসেই মন্টূ রিকশা থামাল। আমি মন্টূ কে বললাম রিকশা থামালে কেন।মন্টূ বলল " স্যার একটু বসেন ,ছোট ভাইয়ের লাইগা দুইটা চকলেট কিন্না আনি ।'' এই কথা বলেই মন্টূ দৌড় দিলো ; মন্টূর পিছনে পিছনে ঝণ্টূও দিলো দৌড়।এই দৃশ্য দেখে আমার চোখ পানিতে ভিজে গেলো এবং মনে মনে ভাবলাম এই হল সৃষ্টিকর্তার তৈরি এক পরম বন্ধন ।